চির-নির্ভয়
(দৈনিক নবযুগ, ৯ই মার্চ, ১৯৪২। নজরুল
রচনাবলী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা ৫১৭-৫২০, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৬)
আমি পেয়ে আল্লার সাহায্য হইয়াছি
চির-নির্ভয়,
আল্লা যাহার সহায় তাহার কোনো ভয় নাহি
রয় !
কোনো বন্ধন বাধা নাই তার কোনো
অভিযান-পথে,
যত বাধা আসে তার কোটি গুণ শক্তি ঊর্ধ্ব
হতে
আল্লার সেই বান্দার বুকে স্রোত-সম নেমে
আসে।
হাতে তার সংহারী-তলোয়ার নেচে ওঠে
উল্লাসে।
অবিশ্বাসীরা শোনো, শোনো,
শোনো সবে জন্মকাহিনী মোর,
আমার জন্ম-ক্ষণে উঠেছিল ঝঞ্ঝা-তুফান ঘোর ।
উড়ে গিয়েছিল ঘরের ছাদ ও ভেংগেছিল গৃহ-দ্বার,
ইসরাফিলের বজ্র-বিষাণ শুনি প্রথম জনমি’ আমি,
‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি শুনি প্রথম জনমি’ আমি,
আল্লাহ নাম শুনিয়া আমার রোদন গেছিল থামি’।
সে পবিত্র ধ্বনি রণরণি’ উঠেছে এ ধমনীতে
প্রতি মুহূর্তে চেতন ও অচেতন আমার এ চিতে।
জন্মক্ষণের সে
ঝড় মোরে টেনে এনে গৃহ হতে
লইয়া ফিরেছে কত অনন্ত অজানা অদেখা পথে।
কত গিরি কত অরণ্য কত সাগর মরুর পারে
জন্মক্ষণের বিষাণ আজান শুনিয়াছি বারেবারে।
কত দারিদ্র অভাব দুঃখ আঘাত দিল সে পথ,
তবু পাইয়াছি আল্লার অহেতুক কৃপা-রহমত !
নিত্য-যুদ্ধ করেছি বাধার সাথে চির-নির্ভিক,
মোর পরিচয় আমি জানি, আমি আজন্ম-সৈনিক।
কোন ভয় মোরে ফিরাতে পারেনি মোর ‘আগে চলা’ থেকে,
কে যেন স্বপ্নে জাগরণে মোর নাম ধরে গেছে ডেকে।
পিছু-ডাকে সাড়া দিইনি কখনো, দেখিনি পিছন পানে ;
শুনিতাম কার মহা-আহ্বান, কাহার প্রেমের টানে
কেবলই কহিত, “হেথা নয়, ওরে আগে চল আরো আগে !”
যত বিদ্রোহী বিপ্লবী ছিল মোর প্রিয়তম সখা,
এদেরই বক্ষে আশ্রয় পেত এই চির-পলাতকা।
নিতি হাহাকার উঠিত এ বুকে, কাহার মহা-বিরহ
অসহ নিবিড় বেদনা কেন যে জাগাইত অহরহ ।
সে কি আল্লাহ ? পরম পূর্ণ আমার পরম স্বামী ?
সে কি মোর চির-চাওয়া পূর্ণতা ? সে কি আমি ? সে কি আমি
?
দ্বন্দ্ব বাঁধিত তাঁহাতে আমাতে, কত যে মন্দ ভালো
কভু নিত মোরে ভিষণ তিমিরে, কভু দিত জ্যোতি আলো ।
কক্ষচ্যুত গ্রহ ধূমকেতু-সম চলিয়াছি ছুটে,
যেতে যেতে কত ভুল-কন্টক ফুল উঠিয়াছে ফুটে ।
কত অপরাধ পাপ করিয়াছি, স্মৃতি হতে তাহা আজ
চির-বিলুপ্ত হইয়া গিয়েছে। অতীত ভেবে কি কাজ ?
অতীতের মলিনতায় রুদ্ধ করেনি আমার পথ,
নিত্য-নূতন গতিবেগে চলে আমার তৃষার রথ।
যে নদীতে স্রোত-প্রবাহ মরেনি, সাগরের তৃষা যার,
কোম মালিন্য করিতে পারে না অশুদ্ধ জল তার।
পুত্র মরিল, লুটায়ে কাঁদিনু । প্রথম পুত্রশোক !
সে মুহূর্তে হেনার সুবাস আনিল চন্দ্রলোক।
ভুলিনু পুত্রশোক, ডুবে গেল সেই সুরভিতে মন ;
বন্ধুরা দেখে কহিল, “পিতা, না পাষাণ এ অচেতন ?”
যে যায় আমার সম্মুখ হতে চিরতরে সে হারায়,
সেই মোর সাথী প্রবল গতিতে যে আমার সাথে ধায়।
আত্মা আমার চিরদিন কেঁদে কয় – “দেরি হয়ে গেল ;
পূর্ণের সাথে শুভদৃষ্টির লগ্ন যে হয়ে এল !”
আগে চলি অনুরাগে, সহসা কে পিছু হতে মোরে টানে ?
এ কি শয়তান, এ কি অজ্ঞান ? – কি জানি … কে জানে ?
কোথা হতে আসে অশান্তি নির্যাতন উপদ্রব,
দেয়ালির আলো দেখে যেন ছুটে আসে পতংগ সব !
আজন্ম সৈনিক
আমি মোর নাহি ক’ মৃত্যু-ভয় ;
মানি না ক’ আমি বাধা ও বিঘ্ন, মানি না ক’ পরাজয় !
মোর আরাধ্য মোর চির-চাওয়া পরম শক্তিমান,
মোরে বাধা দেবে কোন সে রুদ্র নরকের শয়তান ?
সহসা দেখিনু সন্মুখে যেন অসীম নিলাম্বরে
বিপুল বিরাট জ্যোতির্ধনুক উঠেছে আকাশ ভরে।
সে ধনুকের আমি যেন তীর, ধনুকের ছিলা ধরে
শয়তান যেন টানিতেছে মোরে আঁধারের গহ্বরে।
পরম প্রবল আল্লার তেজ কোথা হতে যেন এল,
বহিতে লাগিল প্রলয়ংকর ঝড় যেন এলোমেলো !
জন্মক্ষণের সাথী ঝড় এল বিষাণের আহবান,
“আল্লাহু আকবর” বলি’ আমি ধনুকে মারিনু টান।
শয়তান শিরে মারিলাম লাথি, ছুড়িলাম আমি তীর ;
সে তীর যে স্পর্শ করিল মোর আল্লার নীড় !
চেয়ে দেখি একি পরম বিলাস ! এ যে আল্লাহ মোর ;
কোথা শয়তান ? এ যে আনন্দ-রস-মধু-ঘনঘোর !
অপ্রাকৃত সে মাধুরি তাহার, ভাষায় বলা না যায় ;
সেই জানে যারে জানান, যে এক কণা সে-অমৃত পায়।
আমি আল্লার সৈনিক, মোর কোন বাধা-ভয় নাই,
তাঁহার তেজের তলোয়ারে সব বন্ধন কেটে যাই।
তুফান আমার জন্মের সাথি, আমি বিপ্লবি হাওয়া,
‘জেহাদ’, ‘জেহাদ’, ‘বিপ্লব’, ‘বিদ্রোহ’ মোর গান গাওয়া
!
পুরাতন আর জীর্ণ
সংস্কারের আবর্জনা
দগ্ধ করিয়া চলি আমি উন্মাদ চির-উম্মনা !
কোন আসমান কোন গ্রহ-তারা কোন আবরণ মোরে
কোন শৃংখল কোন কারাগার রাখিতে নারিবে ধরে।
পরম নিত্য পরম পূর্ণ টানে মোরে নিশিদিন,
আমি তাই অপরাজেয় সর্বভয়-ও-মৃত্যুহীন !
-
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলাম
প্রথম প্রকাশঃ দৈনিক নবযুগ, ৯ই মার্চ, ১৯৪২।