ওয়াইসি কে?
-হামিদ মীর (পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক)
সম্প্রতি মিডিয়াতে ভারতের লোকসভার মুসলমান সদস্য আসাদুদ্দীন ওয়াইসিকে নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। ওয়াইসি সাহেব এক বক্তৃতায় বলেছেন, গলায় ছুরি ধরলেও তিনি ‘ভারত মাতার জয়’ স্লোগান দেবেন না। তার বক্তব্য হচ্ছে, আরএসএস বলছে, মুসলমানদের দেশপ্রেমের প্রমাণ দিতে ‘ভারত মাতার জয়’ স্লোগান দিতে হবে, কিন্তু আমি এই স্লোগান দেবো না। কেননা ভারতের সংবিধানে এ স্লোগান দেয়াকে আবশ্যক অভিহিত করা হয়নি। আসাদুদ্দীন ওয়াইসির এই বক্তব্যে আরএসএস ও শিবসেনাসহ অনেক হিন্দু উগ্রপন্থী গোষ্ঠী তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছে। এমনকি ভারতের রাজ্যসভার সদস্য জাভেদ আখতারও ওয়াইসি সাহেবের বক্তব্যের নিন্দা জানাতে সামনে এসে হাজির হয়েছেন। জাভেদ আখতার নামে তো মুসলমান, তবে ধর্ম পালন করেন না। তিনি বিখ্যাত কবি জানেসার আখতারের সন্তান ও আরেক কবি কাইফি আজমির জামাই। খ্যাতনামা নায়িকা শাবানা আজমি তার দ্বিতীয় স্ত্রী। জাভেদ আখতার নিজেও কবি ও সাহিত্যিক। ছয় বছর আগে কংগ্রেস সরকার তাকে রাজ্যসভার সদস্য বানায়। তিনি ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে বক্তৃতা করতে গিয়ে একবার নয়, বরং তিনবার ‘ভারত মাতা কি জয়’ বলেছেন। আসাদুদ্দীন ওয়াইসির বক্তব্যের সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, তিনি একটি রাষ্ট্রের একটি শহরের একটি মহল্লার নেতা, যিনি কিনা বলেন, ভারতের সংবিধানে এ কথা লেখা নেই যে, ‘ভারত মাতার জয়’ স্লোগান দেয়া আবশ্যক। তিনি এ কথা বলুন তো, সংবিধানে তো শেরওয়ানি ও টুপির কথাও উল্লেখ নেই, তাহলে আপনি শেরওয়ানি ও টুপি পরিধান করেন কেন? জাভেদ আখতার একজন প্রগতিবাদী ও সেকুলার মানুষ। তার অর্থ এই নয় যে, তিনি রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে কারো শেরওয়ানি ও টুপি নিয়ে হাসি-তামাশার অবতারণা করবেন। তিনি আসাদুদ্দীন ওয়াইসিকে একজন ‘ইসলামি মৌলবাদী’ মনে করেন। আর ওয়াইসি সাহেবের ধারণা, জাভেদ আখতারের মতো লোকদের কর্মকাণ্ড সেকুলারিজমকে খারাপ করে দিয়েছে।
ওয়াইসি সাহেবের ব্যাপারে জাভেদ আখতারের কথাবার্তা শুনে আমি খুব অবাক হয়েছি। কেননা ওয়াইসি সাহেব যখনই পাকিস্তান আসেন, তখনই তিনি পাকিস্তানে ক্রমবর্ধমান উগ্রবাদ ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে তীব্র অস্থিরতা প্রকাশ করেন। পাকিস্তান এসে তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদী হয়ে যান, তবে ভারতে ফিরে গিয়েই তিনি মুসলমানদের সাথে বেইনসাফি আচরণের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আসাদুদ্দীন ওয়াইসি ও জাভেদ আখতারের মধ্যে বিরোধের মূল নেপথ্য কাহিনী জানা উচিত। সম্ভব হলে ভারতের পরিস্থিতি থেকে কিছু শিক্ষাও গ্রহণ করা উচিত।
আসাদুদ্দীন ওয়াইসির দলের নাম অল ইন্ডিয়া মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলিমিন। এই দলের কাছে হায়দরাবাদ শহর থেকে লোকসভার একটি, তেলেঙ্গানা রাজ্যের অ্যাসেম্বলিতে সাতটি ও মহারাষ্ট্রের অ্যাসেম্বলিতে দুইটি আসন রয়েছে। এ দল মুসলমানদের অধিকারের পতাকাবাহী। তাদের মূল শক্তি মুসলিম ভোটার। এ দল ১৯২৭ সালে গঠিত হয়। তাদেরকে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের জোট মনে করা হতো। কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ একাধিকবার মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের সভায় বক্তৃতা করেছেন।
নওয়াব বাহাদুর ইয়ারজঙ্গ ছিলেন ওই দলের হর্তাকর্তা। তবে হায়দরাবাদের নিজাম উসমান আলী খানও ওই দলের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। পাকিস্তান আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের জন্য রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে হায়দরাবাদ রাজ্যের সাথে জম্মু কাশ্মির রাজ্যের মোকাবেলা শুরু করে দেয়। বলা হতে লাগল, যদি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য হওয়ার কারণে কাশ্মিরকে পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করা হয়, তাহলে হিন্দু সংখাগরিষ্ঠ রাজ্য হওয়ার কারণে হায়দরাবাদকে ভারতের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। স্মর্তব্য যে, জম্মু কাশ্মিরে মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল, তবে শাসক ছিলেন অমুসলিম। আর হায়দরাবাদে হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল, তবে শাসক ছিলেন মুসলমান। ১৯৪৬ সালের ১৬ জুলাই কায়েদে আজম হায়দরাবাদে মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের প্রধান দফতর দারুস সালামে বক্তৃতা করতে গিয়ে হায়দরাবাদ ও কাশ্মির পরিস্থিতির মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, জম্মু কাশ্মিরের মুসলমানদের প্রতিনিধিদল মুসলিম কনফারেন্স পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভুক্ত হতে চাচ্ছে। কিন্তু হায়দরাবাদে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন রাজ্য সরকারের বিলুপ্তির দাবি করেনি। ওই বক্তৃতায় কায়েদে আজম এ-ও বলেছেন, ইত্তেহাদুল মুসলিমিনকে আপনাদের কেন্দ্র বানানোতে বাহাদুর ইয়ারজঙ্গের সাথে আমারও কিছু ভূমিকা ছিল। কায়েদে আজম মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলিমিনকে মুসলিম লিগের সাথে একীভূত করার চেষ্টা করেননি। কেননা তিনি জানতেন, হায়দরাবাদের নিজাম উসমান আলী খান স্বাধীন সার্বভৌম রাজ্যের মর্যাদা পাওয়ার জন্য পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তার নিজস্ব সৈন্য, নিজস্ব বিমান, নিজস্ব মুদ্রা ও নিজস্ব ডাকব্যবস্থা ছিল। তিনি তার স্বাধীন সার্বভৌমত্বের জন্য জাতিসঙ্ঘের সাথে যোগাযোগ করে রেখেছিলেন। কায়েদে আজম ভালো করেই জানতেন যে, জম্মু কাশ্মির রাজ্যে মুসলমানদের প্রতিবন্ধকতার ইতিহাস অনেক পুরনো। পুঞ্ছ এলাকার সরদার শামস খান ১৮২৪ সালে প্রথম বিদ্রোহ করেন। তিনি কয়েক বছর পর্যন্ত মহারাজা রঞ্জিত সিং ও গুলাব সিংয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেন এবং ১৮৩৭ সালে শহীদ হন। কায়েদে আজমের কথাকে ভুল প্রমাণ করতে কংগ্রেস চুপিচুপি হায়দরাবাদে ‘অন্ধ্র হিন্দুসভা’ নামে একটি সশস্ত্র সংগঠন তৈরি করে, যারা হায়দরাবাদকে ভারতের সাথে একীভূত করার দাবি উত্থাপন করে। ওই দাবির পর মুসলমানেরা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। কাসেম রিজভি আনজুমানে ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের পক্ষ থেকে ‘রাজাকার’ নামে সশস্ত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন এবং পাকিস্তানের সাথে হায়দরাবাদের অন্তর্ভুক্তির দাবি করেন। কাসেম রিজভি দেড় লাখের বেশি রাজাকার ভর্তি করান। তবে তাদের কাছে অস্ত্র কম ছিল। হায়দরাবাদের নিজাম পাকিস্তানের নতুন সরকারকে ২০ কোটি রুপির আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। তবে তিনি খোলাখুলি পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভুক্তির কথা বলেননি। তিনি জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌমত্ব অর্জনের চেষ্টা করছিলেন। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কায়েদে আজম ইন্তেকাল করেন। দু’দিন পর ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮ ভারতীয় সেনাবাহিনী হায়দরাবাদে আক্রমণ করে বসে। নিরস্ত্র রাজাকাররা মোকাবেলা করে, কিন্তু ট্যাংকের সামনে টিকতে পারেননি। ৪০ হাজারের বেশি রাজাকার মারা যান। পাঁচ দিন যুদ্ধের পর ১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮ রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করেন। কাসেম রিজভি গ্রেফতার হন এবং মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ভারত সরকার হায়দরাবাদ দখল করে নেয়। জম্মু-কাশ্মিরেও দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে। জাভেদ আখতারের মতো মুসলমানেরা কংগ্রেসের সেকুলারের ছায়াতলে আশ্রয়ের পথ বেছে নেয়। আর কাসেম রিজভি জেলে পড়ে রইলেন। ১৯৫৭ সালে এই শর্তে কাসেম রিজভির জেল থেকে মুক্তি মেলে যে, তিনি হায়দরাবাদে থাকবেন না, পাকিস্তান চলে যাবেন। তিনি জেল থেকে মুক্তি পেয়ে নামসর্বস্ব মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলিমিনকে এক নওজোয়ান আবদুল ওয়াহিদ ওয়াইসির কাঁধে সোপর্দ করে পাকিস্তান চলে যান। ওখানে ১৯৭০ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। এখন পাকিস্তানে তাকে কেউ স্মরণ করে না।
আবদুল ওয়াহিদ ওয়াইসি অল ইন্ডিয়া মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলিমিন নামে নতুন দল গঠন করেন, যা ভারতের সংবিধানকে মেনে নেয়, তবে মুসলমানদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন অব্যাহত রাখে। আসাদুদ্দীন ওয়াইসি ওই আবদুল ওয়াহিদ ওয়াইসির পৌত্র। জাভেদ আখতারের মতো বুদ্ধিজীবী আসাদুদ্দীন ওয়াইসিকে আজো কাসেম রিজভির রাজাকারদের পরম্পরা মনে করেন। হায়দরাবাদ রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে অন্ধ্রপ্রদেশ সৃষ্টি হয়। অতঃপর অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে এক নতুন রাজ্য তেলেঙ্গানার জন্ম হয়। সবকিছু বদলে গেছে। কিন্তু মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলিমিন শেষ হয়নি। আসাদুদ্দীন ওয়াইসি কয়েকবার হাফেজ সাঈদের নিন্দা করেছেন। ভারতের সংবিধানের প্রশংসাও করেছেন।
তারপরও তার দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ করা হচ্ছে। দেশপ্রেমের সার্টিফিকেটের জন্য জাভেদ আখতার আরএসএসের সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু ওয়াইসি তার আপত্তির ওপর দৃঢ়প্রতিষ্ঠ, প্রাণ যায় যাক তবুও ‘ভারত মাতার জয়’ স্লোগান দেবো না।
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ১৭ মার্চ, ২০১৬ থেকে উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব; ahmadimtiajdr@gmail.com
হামিদ মীর : পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক
- See more at: http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/109120#sthash.XMcMsbg2.dpuf